কমাস পর বিচ্ছুর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। কয়েকদিন ধরে ভাবছি বিচ্ছুর শুরুর কাহিনীটা একটু লিখি। যারা বিচ্ছু সম্পর্কে জানেন না, তাদের বলছি- বিচ্ছু একটি সংঘটন যা প্রাণী সংরক্ষণ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে।

আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হয়, তখন প্রথম যে সমস্যাটা ফেস করি তা হলো, ইংরেজি সিলেবাস। বাংলা মিডিয়াম থেকে ইংলিশে হুট করে আসা, তার উপর নতুন নতুন সায়েন্টিফিক টার্ম; আমার সমস্যা হলো, মুখস্থ আমার দ্বারা হয়না। আমার টেকনিকটাই হলো, যত যা পারি পড়বো, সবটা বুঝার ট্রাই করবো, পরীক্ষার হলে নিজের মতো লিখবো! কিন্তু পড়তে গিয়ে খেয়াল করলাম, অনেক টার্ম আছে যা আমি বুঝিনা, ফলে টোটাল মিনিং করতে গেলেই বাঁধে বিপত্তি, সময় দিতে হয় অনেক বেশি। তখন প্রথম চিন্তা আসে এমন একটা ওয়েবসাইট করার যেখানে জুওলজিটা আরো সহজ করে পড়ানো যাবে, অন্তত আমি যা বুঝি তা হলেও যাতে সবাইকে বুঝাতে পারি। অন্য অনেকের কথা জানিনা, আমার সব আইডিয়াগুলো গিজগিজ করে পরীক্ষার আগের রাতে। পরীক্ষা দিতে দিতেই এসব ভাবতাম আর ভাবতাম কখন পরীক্ষাটা শেষ হবে!

আমাদের প্রথম বর্ষ এক্সাম শেষ হয় ২০১৬ এর শুরুর দিকে। এক্সামের পর টানা একমাস সময় পেলাম। বাড়িতে চলে গেলাম আর এই আইডিয়াটাও প্রত্যেকবারের মতো বেমালুম ভুলে গেলাম। এভাবে অনেকদিন কেটে গেলো। দ্বিতীয় বর্ষের চাপ বাড়তে থাকলো। গাজী স্যার একদিন ডেকে বললেন, 'আশেক সেকেন্ড ইয়ারে খুব ভালো মার্ক তোলা যায়, পড়াশোনাটা ভালোমতোন করো'। আমিও খানিকটা সিরিয়াস হবো ভাবলাম। আগ থেকেই বই তই কালেক্ট করলাম। ইন্টারনেট আর্টিকেল সোর্সগুলোও গোছিয়ে নিলাম। প্রস্তুতি নিতে নিতে আমার ফের আগের কাহিনীটা মনে পড়লো। এমন কোন ওয়েবসাইট করা যায় কিনা যাতে অন্তত আমি যা বুঝি তা বুঝানো যাবে। যেহেতু প্রস্তুতি আগ থেকে শুরু করেছি, আমার হাতে তখন অনেক সময়। যদি ভুল না করে থাকি, আমাদের সেকেন্ড ইয়ারের এক্সাম হয়েছিলো ২০১৭ এর মার্চ এর দিকে এবং এক্সামের আগে আগে করে আমি আমার দ্বিতীয় ল্যাপটপটি নিই।

এসএসসির পর আব্বু আমাকে প্রথম একটি ল্যাপটপ কিনে দিয়েছিলেন। তখন থেকেই আমি ফটোশপের কাজ করতাম। তখন নেটের দাম ছিলো অনেক বেশি, বই কিনে নিয়ে এসে বই দেখে দেখে আমি ফটোশপের কাজ শিখেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর প্রথম যে কটেজে উঠি, সেখানেই আমার সেই ল্যাপটপ চুরি হয়ে যায়। এর পর অনেকদিন বাড়িতে জানানোর সাহস হয়নি। পরে যখন দ্বিতীয় ল্যাপটপটি নিলাম, প্রথমেই ওয়েবসাইট কিভাবে বানানো যায় সেসব নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করে দিলাম। বিচ্ছু ওয়েবসাইট ছিলো আমার দ্বিতীয় ইনিসিয়েটিভ। ইন্টারের পর, কয়েকজন বন্ধু মিলে মস্তিষ্ক ডট কম নামক একটি এজুকেশনাল সাইট খোলার উদ্যোগ নিই। কিন্তু ডেভেলপার আর আমাদের কিছু ঝামেলার জন্যে সেটি তেমন আর সুবিধা করতে পারেনি। তাই, এবারে নিজে সব ধারণা নিয়ে মাঠে নামতে চাইলাম। যা ভাবলাম সে অনুসারে এগুতে লাগলাম। এদিকে আমার সেকেন্ড ইয়ার এক্সামও শেষ হলো। ইন দ্যা মীন টাইম অনেক সিনিয়রের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে উঠলো। বিশেষ করে, সুমা, ইরফান ভাই, ইমরান ভাই, আমরা একটা সার্কেল হয়ে গেলাম। আমি তাদেরকে প্রথম আমার আইডিয়াটা শেয়ার করি। সুমাকে বলি, তুমি একটা নাম দাও। সুমা অনেক ভেবে নাম দিলো বিচ্ছু।

বিচ্ছু স্রেফ ওয়েবসাইট হিসেবে যাত্রা শুরু করে ২০১৭ সালের নভেম্বরের ২৪ তারিখ। শুরুর দিকে কন্টেন্ট রাইটার ছিলাম আমরা নিজেরাই। উদ্দেশ্য ছিলো শুধুমাত্র জুওলজির স্টুডেন্টসদের জন্যেই কন্টেন্ট লিখবো, বিশেষ করে এজুকেশনাল কন্টেন্টগুলো। পরে টীমের মেম্বারগুলো নতুন নতুন আইডিয়া দিতে থাকে। সুবিধাভোগী কিভাবে বাড়ানো যায় সেসব নিয়ে আলোচনা বাড়তে থাকে। টীম মেম্বাররা তখন নিজেদেরকেই প্রশ্ন করি, কেন সাধারণ মানুষের প্রাণী সম্পর্কে জানা দরকার? উত্তর একটাই, নিজেদের জন্যেই!

তখনই আমরা আমাদের বিচ্ছুর ট্যাগলাইনটা পেলাম, Save Wildlife to Save Ourselves. প্রাণী বাঁচলেই, বাঁচবে তুমি। আমরা সবাই ইন্টারকানেক্টেড, দাঁড়িপাল্লার এপাশ ওপাশ, কোনটা ইমব্যালেন্স হলে কেউই টিকবোনা। আর সে প্রাণী বাঁচাতে চাইলে, জ্ঞানের বিকল্প নাই। আমরা যেহেতু বাংলা সাবলিল ভাষায় প্রাণী বিষয়ে জ্ঞান বিলাচ্ছি, সর্বস্তরের মানুষ এতে সংযুক্ত হতে আর বাঁধা নাই।

বিচ্ছু, যেটি যাস্ট পরীক্ষার আগের রাতের চিন্তা থেকে শুরু হয়েছে, ধীরে ধীরে এর সাথে রেসপনসেবলিটি যুক্ত হতে থাকে। আমরা শিক্ষার সাথে কনজার্ভেশনের এই লিংক নিয়ে আর কিভাবে কাজ করা যায়, সেটি নিয়ে ভাবতে থাকি। তখনই আমাদের মাথায় আসে ক্যাম্পেইন কার্যক্রমের।

গ্রাম ও শহরতলীর বাচ্চারা শহরের চাইতে বেশি ওয়াইল্ড এনিম্যাল কন্টাক্টে থাকে। আমরা একটি জেনারেশন তৈরীর কাজে নেমে পড়লাম যারা প্রাণী বিষয়ে সহনশীল হবে। যেহেতু কোমলমতি শিক্ষার্থীরা অর্জিত জ্ঞান সারাজীবন ধারণ করে, আমরা ভাবলাম, কেননা তাদের প্রাণী বিষয়ে শিখিয়ে আসি।

তাদের কিভাবে শেখানো যায়?

আমরা প্রথম আমাদের একটি ডকুমেন্টারী বানানোর উদ্যোগ নিই। ততদিনে আমাদের সাথে অনেকেই যুক্ত হয়েছে। জুনিয়রদের মধ্যে অনেকেই নিয়মিত লেখালেখি শুরু করে দিয়েছে। তাদের মধ্যে একজন হলো জহির। জহির আর আমি মিলে প্রথম ডকুমেন্টারির স্ক্রিপ্ট রেডি করি। বাংলাদেশের এ যাবৎ কালে যত প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে এবং যারা বিলুপ্তির পথে সবাই আমাদের ডকুমেন্টারিতে স্থান পেলো। তাদের কেন দরকার সেটিও আমরা তোলে নিয়ে আসলাম। প্রায় ২০ মিনিটের এমন ভিডিও বানালাম যা বাচ্চাদের প্রাণী নিয়ে ভাবাতে বাধ্য করবে, চিন্তাধারা পালটে দিবে!

ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে বিচ্ছু শুধুমাত্র যে ওয়েবসাইট সে গন্ডি থেকে বের হয়ে আসলো। এরপর আমরা নিয়মিতভাবে সেমিনারের আয়োজন করলাম, এনিম্যাল রিলেটেড সোর্সগুলো এভেইলেবল করার উদ্দেশ্যে অনলাইন লাইব্রেরির উদ্যোগ নিলাম, ইত্যাদি ইত্যাদি!

এভাবে চলতে থাকলো অনেকদিন। তারপর আসলো করোনা। সব স্কুল কলেজ বন্ধ! আমাদের ক্যাম্পেইন কার্যক্রমও আর হলোনা। দীর্ঘ একটা বিরতিতে চলে গেলো বিচ্ছু। এদিকে আমরা যারা উদ্যোগটি হাতে নিয়েছিলাম, তাদেরও বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ। এক সময় ভাবলাম, বিচ্ছুর বোধয় আর আগানো হবেনা! কিন্তু না, যারা বিচ্ছুকে ভালোবাসতো তারা চায়না বিচ্ছু থেমে যাক, সাব্বির, শিহার সহ বিচ্ছুর অসংখ্য হিতৈষী যারা বিচ্ছুকে ভালোবাসতো তারা বিচ্ছুর থেমে যাওয়ার ঘোর বিপক্ষে অবস্থান নিলো। আগের কমিটি নতুন নেতৃত্বে কারা কারা আসবে তার একটা রিকমেন্ডশনও আমাদের কাছে পাঠালো। সেদিন, সবাই মিলে যখন নতুন কমিটিতে সাইন করছিলাম, ইরফান ভাই বললেন, 'যাক ভালো লাগতেছে টীমটা এখনো বেঁচে আছে'।

বিচ্ছু কাকে কিভাবে নস্টালজিক করে জানিনা, কাকে কিভাবে উপকৃত করেছে তাও জানিনা; আমার বেলায়, আমি বিশ্ববিদ্যালয় জীবন নিয়ে দু'চার কথা বলতে চাইলে, বিচ্ছু ছাড়া বলতে পারবো বলে মনে হয়না।

Post a Comment

Previous Post Next Post