এই লেখাটি অনেকের জন্য অনাকর্ষণীয় হতে পারে। তবে যদি বিজ্ঞানমনস্ক হন এবং যদি ভেবে থাকেন মানুষই সকল ধ্বংসের মূল এবং এই ন্যারেটিভ থেকে পৃথিবী সংরক্ষণের চিন্তা করে থাকেন, তবে আমি হয়তো অল্প কিছুক্ষণের আলোচনায় আপনাকে ভিন্ন কোনো চিন্তার যোগান দিতে পারবো।


‘রেডিওমেট্রিক ডেটিং’ পদ্ধতির মাধ্যমে পুরোনো ভূতাত্ত্বিক শিলা এবং মহাজাগতিক বস্তু, যেমন ভূপতিত উল্কাপিণ্ড বিশ্লেষণ করে আমরা জানতে পারি পৃথিবীর বয়স প্রায় ৪৫৪ কোটি বছর। ৪৫৪ কোটি বছর মানে অনেকখানি সময়। কিন্তু পৃথিবীতে মানুষের বসবাস ঠিক কতদিন ধরে?  

সহজ করে বললে, আপনি যদি পৃথিবী সৃষ্টির সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত সময়কে এক বছরের সাথে তুলনা করেন, তাহলে যদি পৃথিবীর সৃষ্টি জানুয়ারির ১ তারিখ হয়, তবে প্রথম মহাসাগর ও পৃথিবীতে প্রাণের আভির্ভাব ঘটে ফেব্রুয়ারি-মার্চের দিকে। প্রথম জটিল প্রাণীর বিকাশ ঘটে তারও অনেক পরে, প্রায় নভেম্বরের দিকে। আপনারা যে ডাইনোসরের কথা শুনেছেন, ডাইনোসরের আবির্ভাব ঘটে ডিসেম্বরের ২৬ তারিখের দিকে। তবে মানুষ কখন এলো?  

এই হিসেবে, মানুষের পৃথিবীতে বসবাস শুরু হয় ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ, রাত ১১টা ৫৮ মিনিটে। আপনি যে মানব সভ্যতার ইতিহাস সম্পর্কে জানেন, যেমন লিখিত ইতিহাস, কৃষি কিংবা শিল্প বিপ্লব-তার সূচনা ১১টা ৫৯ মিনিটের পর। অর্থাৎ, মানুষ খুব অল্প সময় ধরে পৃথিবীতে বসবাস করছে। কিন্তু এই অল্প সময়ের ব্যবধানে কী থেকে কী হয়ে গেলো, দেখুন! অসংখ্য গবেষণা রয়েছে যেখানে দেখা যায়, এই ক্ষুদ্র সময়ের মধ্যে প্রচুর প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অনেক বিজ্ঞানী মানুষের কার্যকলাপ দেখে নতুন যুগের নাম দিয়েছেন অ্যানথ্রোপোসিন।  

যাহোক, বর্তমানে আমরা যে যুগে বসবাস করি, তা শুরু হয়েছে প্রায় ১১,৭০০ বছর আগে, সর্বজনস্বীকৃত এই যুগের নাম হলোসিন। পৃথিবীর এই যাত্রাকালে বিভিন্ন সময়কে নানা যুগে ভাগ করা হয়েছে। এখন যে ঠান্ডা শীতল (!) পৃথিবী আমরা দেখতে পাই, পৃথিবী কিন্তু সবসময় এমন ছিল না। পৃথিবী অধিকাংশ সময়ই ছিল উত্তপ্ত, যা নিতান্তই বসবাসের অনুপযোগী। এবং ঠান্ডা ও গরমের পট পরিবর্তন পৃথিবীতে কেবল একবার হয়নি। সময়ের পরিবর্তনে পৃথিবী কখনো ঠান্ডা হয়েছে, কখনো গরম হয়েছে। আমরা যে গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর কথা বলে আতঙ্কিত হই, তা পৃথিবীর আগেকার উত্তাপের তুলনায় কিছুই না!  

মানুষকে কি শুধু গণবিলুপ্তির জন্য দায়ী করা যায়? প্রশ্নটির উত্তর দেওয়ার আগে কিছু ঐতিহাসিক তথ্য সামনে আনি।  

মানুষের আগমনের বহু আগেই পৃথিবীতে পাঁচবার গণবিলুপ্তি হয়েছে। প্রথমবার ৪৪৫ মিলিয়ন বছর আগে অর্ডোভিসিয়ান-সিলুরিয়ান গণবিলুপ্তির ফলে প্রায় ৮৫% সামুদ্রিক প্রাণী বিলুপ্ত হয়, যার প্রধান কারণ ছিল মহাসাগরের তাপমাত্রা পরিবর্তন। এরপর ৩৭৫-৩৬০ মিলিয়ন বছর আগে ডিভোনিয়ান গণবিলুপ্তি ঘটে, তখনও প্রায় ৭৫% সামুদ্রিক প্রাণী বিলুপ্ত হয়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, উদ্ভিদের ব্যাপক বিস্তার এবং আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত পরিবেশের পরিবর্তন ঘটিয়ে এই বিলুপ্তির কারণ হয়েছিল।  

এরপর, প্রায় ২৫২ মিলিয়ন বছর আগে পার্মিয়ান গণবিলুপ্তি হয়, যেখানে ৯৬% সামুদ্রিক এবং ৭০% স্থলজ প্রাণী হারিয়ে যায়। এটি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ গণবিলুপ্তি, যার কারণ ছিল বিশাল আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত এবং জলবায়ুর নাটকীয় পরিবর্তন। প্রায় ২০১ মিলিয়ন বছর আগে ট্রায়াসিক-জুরাসিক গণবিলুপ্তি ঘটে, যাতে ৮০% প্রজাতি হারিয়ে যায়। এর অন্যতম কারণ ছিল জলবায়ুর উষ্ণায়ন।  

সবশেষে, ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে ক্রিটেসিয়াস-প্যালিওজিন গণবিলুপ্তি ঘটে, যার ফলে ডাইনোসরসহ প্রায় ৭৫% প্রজাতি চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এর প্রধান কারণ ছিল বিশাল উল্কাপাত, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত এবং পরিবেশগত পরিবর্তন।  

এখন প্রশ্ন হলো, পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য কি শুধুই মানুষ দায়ী?

সত্যি বলতে, শুধুমাত্র মানুষকে দায়ী করা যৌক্তিক নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের অনেক কারণ রয়েছে এবং মানুষের অনুপস্থিতিতেও পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন হতো।  

পৃথিবী একটি বৃহৎ সিস্টেমের অংশ, যেখানে বিভিন্ন প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া চলে। কখনো স্থিতিশীল থাকে, আবার কখনো অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। সহজ করে বললে, পৃথিবীকে যদি একটি বনজঙ্গলের সাথে তুলনা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে-বাতাস আসবে, ঝড় হবে, বনজঙ্গল ক্ষতিগ্রস্ত হবে, আবার নিজেকে পুনর্গঠিত করবে। কিন্তু কখনো ক্ষতিটি এত বেশি হয়ে যায় যে, তা পুরো পরিবেশকেই বদলে দেয়।  

মানুষ না চাইলেও পৃথিবীর অনেক ফিডব্যাক লুপ আছে, যা পরিবর্তন ঘটায়। যেমন, তাপমাত্রা বাড়লে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যায়। বরফ সূর্যালোক প্রতিফলিত করত, কিন্তু বরফ গলে গেলে সমুদ্রের অন্ধকার জল বেশি তাপ শোষণ করে, ফলে আরও বেশি বরফ গলে যায় এবং উষ্ণতা আরও বাড়ে। অর্থাৎ, জলবায়ু পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবেই ঘটে, তবে মানুষের কর্মকাণ্ড এই পরিবর্তনের গতি বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে।  

কিন্তু মানুষের কি দায়িত্ব নেই?  

পৃথিবীর চলমান পরিবর্তনের গতিপথ সবচেয়ে বেশি বেগবান হয়েছে শিল্প বিপ্লবের পর থেকে। মূল বিতর্ক এখানে নয় যে, মানুষ কিছু না করলে পৃথিবী পরিবর্তন হতো না। বরং, যে পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবে অনেক পরে আসত, তা মানুষের আচরণে অনেক আগেই চলে এসেছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কে?  

অবশ্যই মানুষই!  

মানুষের পরিবর্তন সহনশীলতা অনেক প্রাণীর তুলনায় কম। পৃথিবীতে এমন অনেক প্রাণী ও উদ্ভিদ আছে, যারা পরিবেশের চরম অবস্থাতেও টিকে থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের সভ্যতা এভাবে গড়ে ওঠেনি। তাই পরিবেশের এই পরিবর্তন আসলে আমাদের টিকে থাকার জন্যই হুমকি হয়ে উঠেছে।  

আর তাছাড়া, আমরা যথেষ্ট রেশনাল-আমরা সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় বুঝতে পারি।  আমাদের জন্য যদি অন্যরাও ন্যুণতম ক্ষতিগ্রস্থ হয়, এ দ্বায় কি এড়ানো সম্ভব? আমাদের কাছে থাকা এই জ্ঞান, প্রযুক্তি এবং সামর্থ্য কি শুধু নিজের স্বার্থে ব্যবহৃত হবে? নাকি বৃহত্তর পৃথিবী এবং অন্য জীবদের কল্যাণের জন্যও কিছু করা উচিত? 

এখন সিদ্ধান্ত আপনার-আপনি কি শুধুই নিজের জন্য পরিবেশ রক্ষা করবেন, নাকি বৃহত্তর জীবজগতের জন্যও চিন্তা করবেন?

Post a Comment

Previous Post Next Post