বিষয়টি নিয়ে অনেক দিন লিখবো ভেবেছিলাম। কিন্তু কেন যেন ঠিক লেখা উঠছে না। তবে বাংলাদেশের ঘটে চলা ধারাবাহিক ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে মনে হলো, লেখা ভালো।
স্বাভাবিকভাবে, আপনি যদি অন্যের ভালোর জন্য কথা বলেন, মনে হতে পারে আপনি সঠিক কাজটি করছেন। যেমন, পাহাড়ে পাহাড়িদের উচ্ছেদ হচ্ছে, আপনার মনে হলো, কিছু বলি। কিংবা, কেউ একজন অন্যায়ভাবে মারা গেলো, আপনার মনে হলো বলা ভালো। অবশ্যই যেকোনো অন্যায়ের বিপক্ষে কথা বলা ভালো। তবে সবসময় কি?
ধরুন, আপনি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উচ্ছেদ বা এ ধরনের কোনো বিষয়ে বলবেন। ভালো কথা-ই বলবেন। যেমন, আপনি হয়তো বলতে পারেন, ‘পাহাড়িদের উচ্ছেদ কার্যক্রম বন্ধ করো। নয়তো গণআন্দোলন গড়ে তোলা হবে।’ কী সমস্যা হতে পারে আপনার এমন বক্তব্যের পর? হয়তো আপনার এমন দাবিটি খুব বিখ্যাত হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে দুটি সমস্যা হতে পারে।
প্রথমত হলো, যেহেতু আপনি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত নন, তাই সম্ভাবনা আছে যে, আপনি আসলেই জানেন না পাহাড়িরা আসলে কী চায়। হয়তো পাহাড়িদের উচ্ছেদ কার্যক্রম এটাই প্রথম নয়। তারা হয়তো শুধু উচ্ছেদ কার্যক্রম বন্ধ চাইছে না; তারা উচ্ছেদকারীদের পুনর্বাসনও চাচ্ছে। কিন্তু আপনার অজ্ঞতার কারণে আপনি তাদের হয়ে সঠিক চাওয়াটি সবার কাছে পৌঁছে দিতে পারেননি। পরবর্তীতে আপনার দাবির প্রেক্ষিতে উচ্ছেদ কার্যক্রম বন্ধ হলেও কিন্তু তাদের আসল দাবি পূরণ হলো না।
দ্বিতীয় সমস্যা হলো, আপনার বলার কারণে তাদের প্রকৃত দাবিটা চাপা পড়ে যেতে পারে। যেহেতু আপনি প্রিভিলেজড এবং আপনার অনেক কানেকশন রয়েছে, তাই আপনি সবার কাছে যেভাবে আপনার অর্ধসত্য দাবিটি পৌঁছে দিলেন, সেটি হয়তো পাহাড়িদের আসল চাওয়াটাকে ধামা চাপা দিতে পারে, ইভেন প্রশ্নবিদ্ধও করতে পারে। হয়তো সমাজে পোলারাইজেশন তৈরি হবে; এক পক্ষ হাসি-তামাশা করবে, নতুন বিপক্ষ মত গড়ে তুলবে, যা যদি সঠিক দাবিটি আগে করা হতো, হয়তো এমনটা হতো না।
আর তাছাড়া আপনার দ্বিতীয় লাইন, ‘নয়তো গণআন্দোলন গড়ে তোলা হবে’, হয়তো কখনোই পাহাড়িদের বক্তব্য ছিল না। তারা হয়তো আন্দোলনের জন্য কখনোই প্রস্তুত ছিল না। আপনার এ ধরনের রাজনৈতিক বক্তব্যের কারণে হয়তো রাষ্ট্রপক্ষ এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর আরও ক্ষেপে যেতে পারে, যা সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
এ ধরনের সমস্যা নিয়ে লিন্ডা আলকফ তার গ্রন্থ ‘The Problem of Speaking for Others’ বইয়ে আলোচনা করেছিলেন। তার মতে, উপরের এই দুই সমস্যার কারণে আমাদের অন্যের জন্য কথা বলার আগে সতর্ক থাকা উচিত।
তিনি বলেন, যখন আপনি অন্যের জন্য কথা বলতে চাইবেন, তখন আপনার কথা বলার পেছনের আসল মোটিভেশনটি যাচাই করা উচিত। যদি আপনার আসল উদ্দেশ্য সত্যিই অন্যের জন্য কথা বলা হয়, তবে আপনার ব্যক্তিগত অভিমত বা মতাদর্শকে কখনোই প্রাধান্য দেওয়া উচিত নয়। যেমন, আপনি যখন বললেন, ‘নয়তো গণআন্দোলন গড়ে তোলা হবে’, এটি হয়তো একান্তই আপনার ব্যক্তিগত আগ্রহের বিষয়। আপনি হয়তো গণআন্দোলনকে সমর্থন করেন বা প্রকাশ করতে চান যে আপনি বা আপনারা দুর্বল নন। দাবিটি মানতেই হবে।
আরেকটি বিষয় হলো, আপনি যদি অন্যের জন্য কথা বলেন, তবে আপনার উচিত সত্য বলা এবং দায়িত্ব নিয়ে বলা। যা অনেকের ক্ষেত্রে হয়তো সম্ভব হয়ে ওঠে না।
কোন পরিস্থিতিতে আপনার অন্যের জন্য কথা বলা উচিত?
এমন কিছু মুহূর্ত আছে যখন আপনার সত্যিই অন্যের জন্য কথা বলা উচিত। যেমন:
কিছু ক্ষেত্রে মার্জিনাল গ্রুপ কথা বলতে পারেনা, সেক্ষেত্রে আপনার এক্সেস থাকলে আপনার কথা বলা উচিত। যেমন, আপনি যদি পার্লামেন্টের মেম্বার হয়ে থাকেন, আপনার যদি পলিসি মেকিংয়ের সময় কথা বলার সুযোগ থাকে যা এই কেইস পার্সফেক্টিভে হয়তো পাহাড়িদের নাই, তখন আপনার অবশ্যই তাদের হয়ে কথা বলা উচিত।
জরুরি পরিস্থিতিতে আপনি কথা বলতে পারেন। ধরুন, এখনই আপনাকে কোনো একশন নিতে হবে। কিন্তু যাদের জন্য একশন নিবেন, তারা কেউই সেই মুহূর্তে উপস্থিত নয়। কিন্তু একশন না নিলে তাদের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। তখন অবশ্যই আপনার কথা বলা উচিত।
যদি আপনি দীর্ঘদিন ধরে মার্জিনাল গ্রুপ যেমন পাহাড়িদের নিয়ে কাজ করে থাকেন এবং আপনি তাদের আসল উদ্দেশ্য জানেন এবং মনেপ্রাণে সেটিই চান, তবে আপনার কথা বলা উচিত। সহজভাবে বললে, আপনি যদি মনেপ্রাণে পাহাড়িদের মতোই ভাবেন এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও চাওয়া-পাওয়া বুঝতে পারেন, তবে অবশ্যই কথা বলা উচিত।
যারা অন্যদের জন্য কথা বলতে চান, তাদের জন্য কিছু গাইডলাইন:
মোটিভেশন যাচাই করুন: আপনার আসল উদ্দেশ্য বুঝতে চেষ্টা করুন। যদি দেখেন, আপনি কোনো অসৎ বা ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলছেন না, তবে আপনি এগোতে পারেন।
পরিচয় স্পষ্ট করুন: যদি কথা বলেন, তবে অবশ্যই ব্যাখ্যা করে দিন যে আপনি সেই কমিউনিটিতে অন্তর্ভুক্ত নন। যদি এটি না করেন, তাহলে আপনার বক্তব্যকে ১০০% সত্য ধরে নেওয়া হতে পারে।
তাদের হয়ে নয়, তাদের নিয়ে বলুন: যদি কথা বলতেই হয়, তবে যাদের জন্য কথা বলতে চান, তাদের নিয়েই বলুন। অর্থাৎ, ‘তাদের জন্য’ নয়, বরং ‘তাদের নিয়ে’ বলুন।
সমালোচনা গ্রহণ করুন: যদি কেউ আপনার সমালোচনা করে বা বলে যে আপনি পুরোপুরি সত্য বলেননি, তাহলে বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিন। নিজেকে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করবেন না। বরং প্রয়োজনে নিজেকে সংশোধন করুন।
সুযোগ থাকলে তাদের কথা বলার সুযোগ দিন: যদি সুযোগ পান, তাহলে অবশ্যই যাদের নিয়ে কথা বলতে চান, তাদেরকেই কথা বলার সুযোগ দিন। তারা যদি তাদের দায়িত্ব বুঝে নিতে পারে, তাহলে আপনার আর আলাদা করে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। পারলে তাদের কথাকে সম্প্রচার করুন।
আজকের মতো আলোচনা এখানেই শেষ। আমি জানি, এই লেখাটি অনেক বেশি তাত্ত্বিক হয়ে গেছে। তবে আমি যখন বিষয়টি পড়েছিলাম, তখন থেকেই মনে হচ্ছিল এটি নিয়ে কিছু লিখবো। অবশেষে লিখে ফেললাম।
আশেক
ফ্লাইসাভিজে, জার্মানি

Post a Comment