জার্মানিতে আসার পর, জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বিষয়গুলো আমার ভালো লেগেছে এবং সামহাউ মনে হয়েছে-এই সুবিধাগুলো যদি আমার ব্যাচেলরে থাকত, কতই না ভালো হতো!
প্রথমত, তাদের সময় সচেতনতা ও সময় বণ্টন। উন্নত বিশ্বের মানুষ সময়ের মূল্য কাটায় কাটায় বোঝে। তাদের প্রতিটি কাজ নির্দিষ্ট সময়সূচির মধ্যে আটকে থাকে। অনেকের কাছে এটি মেনে চলা কঠিন মনে হতে পারে, কিন্তু বিশ্বাস করুন, সময়ের সঙ্গে এই জীবনধারায় অভ্যস্ত হওয়া যায়-এবং হওয়া উচিত। কোনো হুটহাট পরিকল্পনা নয়, বরং অন্তত এক সপ্তাহ আগেই পরিকল্পনা করুন, দেখবেন-কিছু না করার আফসোস আপনার মধ্যে আর থাকবে না। জার্মানদের এই আচরণ আপনি সব ক্ষেত্রেই দেখতে পাবেন। যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনি ৬ ক্রেডিটের একটি কোর্স নিলে ঠিক কত ঘণ্টা আপনাকে পড়াশোনায় সময় দিতে হবে, তা তারা নির্ধারণ করে রাখে। ফলে কখনোই মনে হবে না এটি অসাধ্য! তবে হ্যাঁ, আপনি যদি ভিন্ন দেশ থেকে আসেন এবং যে বিষয়টি পড়ানো হবে, সে সম্পর্কে ধারণা না থাকে, তাহলে আপনার যাত্রা এতটা মসৃণ নাও হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, তাদের পরীক্ষা পদ্ধতি। দেশে থাকতে আমরা শুধু লিখিত পরীক্ষা দিয়েছি, ভাইভায় একটু-আধটু কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু এখানে পরীক্ষা পদ্ধতি নানান রকম। কোনো কোর্সে লিখিত পরীক্ষা, কোনো কোর্সে মৌখিক, কোনো কোর্সে কেবল প্রেজেন্টেশন, আবার কোনো কোর্সের মূল্যায়ন হয় শুধু হোমওয়ার্কের ভিত্তিতে। তারা এমনভাবে ব্যবস্থা করে যে, আপনি যা-ই করুন না কেন, শিখতেই হবে! ফলে শুধু শেখাই নয়-আপনার কথা বলার দক্ষতা, পাবলিক স্পিকিং, আত্মবিশ্বাস-সবকিছুই বেড়ে যাবে। দুর্দান্ত না?
তৃতীয়ত, অধিকাংশ মাস্টার্স কোর্সে পছন্দের মডিউল বেছে নেওয়ার সুযোগ। সব ক্ষেত্রে না হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ সুবিধা পাওয়া যায়। ফলে সতর্ক হয়ে মডিউল নির্বাচন করলে আপনি নির্দিষ্ট একটি সেক্টরে নিজেকে বিশেষজ্ঞ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবেন। আর যদি কোনো সমস্যায় পড়েন, তাহলে কম কোর্স নিতে পারেন এবং পরে সেগুলো কাভার করতে পারবেন। এতে অনেকের জন্য ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স করা সহজ হয়ে যায়।
চতুর্থত, গবেষণাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত-আপনাকে যৌক্তিক চিন্তায় পারদর্শী করে তোলা। প্রতিটি কথার পেছনে যুক্তি ও উপাত্ত থাকা জরুরি। কিন্তু আমাদের দেশে এ বিষয়ে যথেষ্ট উদাসীনতা দেখা যায়। যেন যেকোনোভাবে ডিগ্রি নিয়ে চাকরিতে ঢুকলেই হবে, গবেষণার দরকার নেই! সত্যিই কি তাই? আপনি যদি সফল কৃষকও হতে চান, গবেষণার প্রয়োজন হবে। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এটি অত্যন্ত গুরুত্ব পায়। প্রফেসরদের লেকচারে প্রতিনিয়ত গ্রাফ ও উপাত্ত থাকে, যা সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে নেওয়া। এমনকি কোনো প্রেজেন্টেশন বা হোমওয়ার্ক করলেও তথ্যের উৎস উল্লেখ করতে হয়। কোনো বিষয়ের ওপর কথা বলতে হলেও নোটবুক নয়, সাম্প্রতিক গবেষণার দিকে নজর দিতে হয়। এতে প্রথমে চাপ মনে হতে পারে, কিন্তু এটা শুধু অভ্যাসের ব্যাপার।
পঞ্চমত, শিক্ষার্থীদের জন্য নানা সুবিধা। এখানে আপনাকে এমনভাবে সহায়তা করা হবে যে, কোনো ঘাটতি মনে হবে না। উদাহরণস্বরূপ, ভর্তি হওয়ার পরপরই একটি ইমেইল আইডি দেওয়া হবে, যা শুধু ইমেইল ব্যবহারের জন্য নয়-বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে লগইন করা, কী পড়বেন বা পড়বেন না তা বেছে নেওয়া, আপডেটেড গ্রেডশিট দেখা, লাইব্রেরি থেকে বই নামানো, জার্নাল পড়া-সবকিছুই এতে অন্তর্ভুক্ত। অবৈধভাবে কোনো বই ডাউনলোড করতে হবে না। গবেষণা প্রকাশের ক্ষেত্রেও সুবিধা পাবেন। এমনকি নিয়মিত প্রাসঙ্গিক চাকরির তথ্যও জানানো হয়।
এছাড়াও রয়েছে-উন্নত অবকাঠামো, লজিস্টিক সুবিধা, বড় অ্যালামনাই নেটওয়ার্ক, এবং আরও অনেক কিছু!
ভাবুন তো, এসব সুবিধা যদি আপনার ব্যাচেলরে থাকত, নিশ্চিতভাবেই আপনি আরও এগিয়ে যেতে পারতেন, তাই না? তবে বাংলাদেশের বর্তমান একাডেমিক কাঠামোতে এসব কিছু গ্রহণ করা কতটা কঠিন? অবশ্যই সবকিছু সম্ভব নয়, কিন্তু আমি মনে করি, শুধু কাঠামোগত কিছু পরিবর্তনেই অনেক কিছুই বাস্তবায়ন করা সম্ভব!

Post a Comment