আমি যখনই স্কলারশিপ বিষয়ে লিখেছি, অধিকাংশ সময় খেয়াল করেছি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা এমন কিছু কমেন্ট করেছেন যা আমাকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে আলাদাভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে। প্রথমত, আমার স্ট্যান্ডপয়েন্টটি বলি। আমি মনে করি না, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাক্ষেত্রে কম সুবিধা পান কিংবা তারা চেষ্টা করার পরও পিছিয়ে থাকবেন। তাহলে সমস্যাটি কোথায়? এটি কোনো গবেষণা করে বের করা তথ্য না, তবে আমি মনে করি, তারা এমন পরিবেশে বড় হন যেখানে হয়তো বাইরের দেশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা খুবই কম। এটি একটি পজিটিভ ফিডব্যাক লুপের মতো- দেখতে দেখতে বাড়বে, কিন্তু শুরুতেই সেই ইনিশিয়াল থ্রেশহোল্ডটি আসছে না। আবার যেহেতু উদাহরণও কম, তাই অনেকে সাহস করতে পারছেন না; মনে করছেন অসম্ভব।


তবে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু প্রার্থী এই ব্যারিয়ার একদম টপকাচ্ছেন না, এমনও না। আমি আজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলাদেশের অন্যান্য পাবলিক বা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিধার তুলনায় কোন কোন জায়গায় উন্নতি করলে সাফল্যের হার বাড়ানো সম্ভব তা আলোচনা করবো।

দেশের বাইরে পড়তে যাবার প্রসঙ্গ উঠলেই প্রথম যে সমস্যার কথা সবার মনে আসে তা হলো ইংরেজি ভাষার দক্ষতা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেহেতু ইংরেজি ভাষার জ্ঞানকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়, খুব স্বাভাবিকভাবেই সেখানে পড়া শিক্ষার্থীদের IELTS বা ভাষা-সম্পর্কিত পরীক্ষাগুলোতে দ্রুত ভালো করার সুযোগ থাকে। অন্যদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শুরুতেই ভাবেন কিভাবে ইংরেজি দক্ষতা পরীক্ষাগুলো এড়িয়ে যাওয়া যায়! ফলে, তারা খোঁজেন কিভাবে IELTS ছাড়া বিদেশ যাওয়া সম্ভব।

আপনার ভাবনাও যদি এমন হয়ে থাকে, তবে স্কলারশিপ তো দূরের কথা, বিদেশে আসার সুযোগও অনেক সংকীর্ণ হয়ে যাবে। এটা কি খুব অবাক করার মতো না যে আপনি দেশের বাইরে আসবেন, যেখানে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ পাওয়া খুব কঠিন, অথচ আপনি ইংরেজির মতো একটি সাধারণ ভাষা জানবেন না! আপনি লেকচার বুঝবেন কীভাবে? বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করবেন কীভাবে? যদি ভাবেন এখানে এসে শিখে নেবেন, সেটিও কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে? বিদেশে যেমন ইনকাম বেশি, খরচও মারাত্মক। আপনি পড়াশোনা করবেন, না নিজের থাকা-খাওয়ার ব্যাবস্থা করবেন, না কি ইংরেজি শিখবেন?

তাই বুদ্ধিমানের কাজ হলো এখন থেকেই ইংরেজি দক্ষতা বাড়ানো। ইন্টারনেটের এই যুগে সবকিছু হাতের নাগালে। অনলাইনে ভিডিও দেখুন, প্র্যাকটিস করুন, হাঁটতে-চলতে প্র্যাকটিস করুন। শুরু করতে হবে যেখানে আছেন সেখান থেকেই- প্রচুর চেষ্টা করুন এবং ইংরেজি দক্ষতা যতটা সম্ভব উন্নত করুন। কারণ ইংরেজি হলো অনেক স্কলারশিপের বাধ্যতামূলক শর্ত। ভালো স্কোর থাকলে যোগ্যতার প্রমাণও দৃঢ় হয়। ফলে স্কলারশিপ পাওয়ার সম্ভাবনাও বাড়ে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় পার্থক্য হলো গবেষণার সুযোগ। স্কলারশিপ পাওয়ার ক্ষেত্রে গবেষণা দক্ষতা অনেক সময় বড় ভূমিকা রাখে।
তবে কিছুক্ষেত্রে গবেষণা অভিজ্ঞতা না থাকলেও স্কলারশিপ পাওয়া সম্ভব। অনেকের সাথে আলোচনায় জানতে পেরেছি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গবেষণার সুযোগ তুলনামূলকভাবে কম থাকে। সত্যি বলতে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও গবেষণায় আগ্রহী শিক্ষার্থী অহরহ পাওয়া যায়, এমন না। তাছাড়া, বাংলাদেশী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও গবেষণার মারাত্মক লেভেলের সুযোগ বেশি, এমনও না। তবে কেউ যদি আন্তরিক হয়, ওয়ে বের করতেই পারে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও পারবেন, যদি একটু সচেষ্ট হন। বাংলাদেশে এখন অনেক গবেষণা ক্লাব রয়েছে, অনেক শিক্ষক আছেন যারা প্রচুর শিক্ষার্থী নিয়ে কাজ করেন।

আপনার ফিল্ডের সাথে সম্পর্কিত কারা ভালো কাজ করছেন তা খুঁজে বের করুন, তাদের সাথে যোগাযোগ করুন। সুযোগ তৈরি করুন। গবেষণায় যুক্ত থাকতে হলে একটিভ থাকতেই হবে- এটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হোক বা অন্য যে কোনো প্রতিষ্ঠান।

এরপরের সমস্যা হলো তথ্য ঘাটতি। যেহেতু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদেশে যাওয়ার সংখ্যা তুলনামূলক কম, সেকারণে অনেকেই ভাবেন, প্রপার গাইডলাইন পাওয়া কঠিন। তবে মনে রাখবেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা কোনো আবেদন প্রক্রিয়া নেই। যেসব স্কলারশিপের জন্য আবেদন করতে চান, সেসবের তথ্য অনলাইনেই রয়েছে। আপনার কাছে ইন্টারনেট এক্সেস আছে মানে এই অজুহাতের দরকার নাই!

আমি যখন আবেদন করেছিলাম, তখন কারো সাজেশন্স নিয়ে শুরু করিনি- নিজে নিজেই খোঁজ-খবর করেছি। এটা-ই স্বাভাবিক পদ্ধতি। প্রচুর খোঁজা-খুঁজি করেই আপনাকে এগোতে হবে। স্কলারশিপ পেতে হলে প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে, জানতে হবে কোথায় কী সুযোগ আছে, কীভাবে আবেদন করতে হবে- একদম পরিষ্কার ধারণা রাখতে হবে।

তথ্য অনুসন্ধান করা একদিনের কাজ নয়- এটি জীবনযাপনের একটা অংশ হওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই চোখ-কান খোলা রাখুন, তাহলেই হবে!

আরেকটি সাধারণ সমস্যা হলো ডকুমেন্টস রেডি করা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন ডকুমেন্টস প্রস্তুত করতে যান তখন অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকেন-এটা লাগবে কি না, ওইটা লাগবে কি না।
প্রথমত, আপনি যে স্কলারশিপে আবেদন করছেন, সেখানে পরিষ্কার করে লেখা থাকে কী কী ডকুমেন্টস লাগবে। আপনার প্রথম কাজ হবে মনোযোগ দিয়ে বুঝার চেষ্টা করা। না বুঝলে অন্যদের সঙ্গে পরামর্শ করুন, ইউটিউব, গুগল ঘাটুন। দেখবেন সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। অকারণে টেনশনের কোনো প্রয়োজন নেই।

এর বাইরে যদি স্কলারশিপ পেতে চান, তবে অবশ্যই আপনার CGPA যত বেশি রাখা যায় তত ভালো। ভলান্টারি কাজের সাথে যুক্ত হোন, যদি সম্ভব হয় তবে সাবজেক্ট-রিলেটেড কোনো চাকরিতে যুক্ত হোন। কারণ কিছু স্কলারশিপ যেমন DAAD স্কলারশিপ, সেখানে প্রফেশনাল এক্সপেরিয়েন্স এর রেকয়ারমেন্ট রাখা আছে।

সবশেষে বলি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মানেই নিজেকে হীনভাবে দেখার কোনো মানে নেই। স্কলারশিপ দেয়ার সময় আপনার ইউনিভার্সিটি দেখে বিচার করা হয় না। রিক্রুটার বা স্কলারশিপ কমিটির অনেকেই হয়তো জানেনই না জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্থক্য কী। ইভেন হয়তো যে পাবলিকে না পড়ার কারণে আপনি নিজেকে পিছিয়ে আছেন ভাবছেন তার নামও তারা জীবনে শুনে নাই।

স্কলারশিপ তারা-ই পান যারা যোগ্য। নিজেকে যোগ্য করে তুলুন, তাহলেই হবে!

আপনি যদি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হন বা আপনার পরিচিত কেউ হন, তাহলে তাকে এই লেখাটি শেয়ার করতে পারেন।

লেখা: আবদুল্লাহ আল আশেক
ডিএএডি স্কলার, গ্রাইফসভাল্ট বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মানি

Post a Comment

Previous Post Next Post