পহেলা বৈশাখ এলেই ইলিশ নিয়ে আলোচনা বেড়ে যায়। বাঙালির শত বছরের ঐতিহ্য-এই ঐতিহ্যের অন্যতম অনুষঙ্গ এই ইলিশ। পান্তা ভাতের সাথে ইলিশ, পাশে একটি পেঁয়াজের ফালি, আর একটি কাঁচা বা শুকনো মরিচ-পরিবেশন করতে হবে মাটির প্লেটে। কী দুর্দান্ত কম্বিনেশন! ছবি তোলার জন্য তো অন্তত ‘পারফেক্ট’ বলা চলে!
কিন্তু এই পান্তা-ইলিশ কি আসলেই বাঙালির ঐতিহ্য? যদি আপনি মনে করেন অতিপরিচিতি মানেই ঐতিহ্য, তাহলে পান্তা-ইলিশকে ঐতিহ্য বলা যেতেই পারে। তবে আমাদের যেকোনো কিছু ঐতিহ্যে রূপ দেওয়ার যে প্রবণতা, সেটি যথেষ্ট বিব্রতকর।
যাহোক, ইলিশের সঙ্গে পান্তার এই কম্বিনেশন এবং এসব খাবার আসলে অতীতে সাধারণ মানুষের নাগালে ছিল কি না-এটি নিয়ে কিছুদিন আগে একটি সংবাদ প্রতিবেদন পড়েছিলাম। যেহেতু আমার বাঙালির ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণার সুযোগ হয়নি, তাই সরাসরি সেই প্রতিবেদন ধরেই বিষয়টি নিয়ে আগাতে চাই।
বাঙালির ঐতিহ্য নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। তাঁর মতে, আগেকার দিনে কৃষকদের ইলিশ মাছ কেনার সামর্থ্য কম ছিল। ইলিশ তখন থেকেই দামি মাছ হিসেবে বিবেচিত হতো। এর কারণও পরিষ্কার। ইলিশ বাংলাদেশের সব জায়গায় পাওয়া যেত না, ধরতেও লাগত অনেক বেশি পরিশ্রম। খুব স্বাভাবিকভাবেই এটি সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে ছিল। ফলে এর দামও বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। শামসুজ্জামান খানের মতে, বৈশাখ যেহেতু খরার মাস-ফসল না হওয়ার মাস-তখন কৃষকের হাতে অর্থের ঘাটতি থাকত। সে সময় আড়ম্বর করে পান্তা-ইলিশ অন্তত তাদের পাতে ওঠার কথা না।
তাহলে ইলিশের এই ঐতিহ্য আসলে ঐতিহ্য হলো কীভাবে? এটাও খুবই মজার-আশির দশকে এক ভদ্রলোক এই প্রস্তাবটি রাখেন, আর সেখান থেকেই এটি হয়ে যায় শত বছরের ঐতিহ্য!
বাঙালি জাতিকে ম্যানিপুলেট করা খুবই সহজ। এর অন্যতম কারণ হলো অজ্ঞতা, আরেকটি হলো প্রশ্ন না করার স্বভাব। আমরা অধিকাংশ সময় নিজেরাই ম্যানিপুলেট হতে চাই, তাও আবার কোনো রকম চেষ্টা না করেই! ধরুন, আপনাকে কেউ কোনো তথ্য বা যুক্তি দিয়ে কিছু উপস্থাপন করল-সেটিই তখন আমাদের রেফারেন্স হয়ে যায়। এতটুকু চিন্তা করি না-এটা আসলে সত্য কি না। এর বাইরে, যদি সেটি যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে যায়, তাহলে তো আর কথাই নেই। তাই তো অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের বুদ্ধিজীবী নির্ধারণের মাপকাঠিও পুরো বিশ্বের চেয়ে আলাদা।
মূল প্রসঙ্গে ফিরি-কথা হচ্ছিল ইলিশ নিয়ে। ইলিশের প্রজননের একটি নির্দিষ্ট সময় আছে। সেই সময়কে মাথায় রেখে কখন ইলিশ ধরা যাবে, আর কখন যাবে না-সে বিষয়ে সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করে। আপনারা হয়তো জাটকা সম্পর্কেও জানেন। সহজ ভাষায়, অপরিপক্ব ইলিশকে জাটকা বলা হয়। এই অপরিপক্ব ইলিশ যাতে বড় হতে পারে, সেজন্য প্রতি বছর ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ইলিশ ধরা, পরিবহন, মজুত কিংবা ক্রয়-বিক্রয় করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তার মানে, আপনি পহেলা বৈশাখে ইলিশ খেলে-যদি সেটা ফ্রিজে রাখা গত বছরের মাছ না হয়-তাহলে আপনি আইন লঙ্ঘন করছেন।
আমার মতে, ইলিশ একটি রাজনৈতিক মাছ। বাংলাদেশে যদি ভাতের দাম বাড়ে, তাহলে বোঝা যায় মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। আর যদি ইলিশের পরিমাণ বাড়ে, তাহলে বলা হয়-বাংলাদেশ মৎস্য খাতে দারুণ সাফল্য অর্জন করেছে! যদিও এটি কোনো চাষযোগ্য মাছ নয়!
ধরুন, আপনি মুরগির খামার করলেন, প্রচুর মুরগি উৎপাদন করলেন-এটা কৃষিখাতে সাফল্য। আবার ধানের উৎপাদন যদি আগের বছরের তুলনায় বাড়ে, সেটাও সাফল্য। কিন্তু আপনি এমন কিছু উৎপাদন করছেন না, যা স্বাভাবিকভাবেই বাড়ছে-তাহলে সেটি আসলেই সাফল্য কি?
হ্যাঁ, এটাও এক ধরনের সাফল্য হতে পারে-আপনি বলতে পারেন, আপনার ব্যবস্থাপনা ভালো ছিল, তাই উৎপাদন বেড়েছে।
মজার বিষয় হলো, অনেক সময় এমনটাই দাবি করা হয়!
বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তর থেকে প্রতি অর্থবছরে ‘ইয়ারবুক অব ফিশারিজ স্ট্যাটেস্টিক্স অব বাংলাদেশ’ নামের মাছের পরিসংখ্যানবিষয়ক একটি বই প্রকাশিত হয়। আমি অবাক হয়ে খেয়াল করেছি-ইলিশ নিয়ে আলোচনা এলেই তারা আগের বছরের বই থেকে সরাসরি কপি করে দেয়! একবার নয়, বহুবার! ভাবুন ব্যাপারটা!
আর সেই লেখার সারকথা-সরকারের ব্যবস্থাপনা ভালো ছিল, তাই উৎপাদন বেড়েছে।
মজার ব্যাপার এখানে শেষ হয়নি, আরো আছে! তারা ইলিশের বৃদ্ধি রীতিমত পরিসংখ্যানের মাধ্যমে প্রমাণ করেছে। যেমন, ২০০১-০২ অর্থবছরে ইলিশের পরিমাণ ছিল প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন। ২০০২-০৩ এ তা কমে দাঁড়ায় প্রায় ১ লাখ ৯৯ হাজার টনে। হুট করে একটু কমে গেল, তাই না? সত্যি বলতে, কেন কমেছে সেটা যথেষ্ট সন্দেহজনক।
কারণ, এরপর থেকে আজ পর্যন্ত আর কোনো বছরই উৎপাদন কমেনি-শুধুই বেড়েছে! যেমন, ২০০৩-০৪ সালে প্রায় ২ লাখ ৫৬ হাজার, তারপরের বছর ২ লাখ ৭৬ হাজার, তারপর ২ লাখ ৭৭ হাজার মেট্রিক টন। এবং এই বৃদ্ধির ধারা চলতে চলতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ লাখ ৭১ হাজার মেট্রিক টনে! কী আশ্চর্য! প্রতি বছরই বেড়েছে! ভুল করে কখনো যেনো কমলোই না। কি অবেডিয়েন্ট ইলিশ ভাবা যায়! আপনারা এমনই পরিসংখ্যান চালিয়ে যান। যদি আল্লাহ চান, আমার জীবদ্দশায় হয়তো এক কোটি মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদিত হতে দেখে যেতে পারব!
আসলে আমি এই বৃদ্ধিকে নিয়ে প্রশ্ন তুলতাম না-কিন্তু প্রশ্ন করতে হয়, কারণ প্রতি বছরই তাদের একই সুর ‘ম্যানেজমেন্টের উন্নয়নের কারণে ইলিশের পরিমাণ বেড়েছে’, এবং সেটিকে বেইজ করে রাজনৈতিক ক্রেডিটও নেওয়া হয়। একদিকে বলছেন ব্যবস্থাপনা জোরদার হয়েছে, অন্যদিকে দেশে নতুন নতুন জাল আর আধুনিক মাছ ধরার যন্ত্রের সয়লাব!
আমার মতে, মাছের পরিমাণ যদি বাড়েও, তবে সেটা ব্যবস্থাপনা জোরদারের জন্য নয়-বরং ব্যবস্থাপনায় ঘাটতির কারণেই!
বিষয়টি পরিষ্কার করি। একটা ইনভায়রনমেন্টে সর্বোচ্চ কতটুকু মাছ বা যেকোনো প্রজাতির সংখ্যা থাকতে পারবে তা আপাতভাবে একটা রেঞ্জের মধ্যে থাকে। সহজ করে বললে, কোনো পরিবেশে একটি সুনির্দিষ্ট সংখ্যার বাইরে কোনো প্রজাতিই বাড়তে পারবে না। সর্বোচ্চ সংখ্যার এই সীমাকে বলা হয় ক্যারিয়িং ক্যাপাসিটি।
ধরুন, আপনি মুরগি পালন করেন, আপনার খামারে সর্বোচ্চ কয়টি মুরগি রাখতে পারবেন তা রেস্ট্রিকটেড। এর বেশি রাখতে চাইলে, আপনার কিছু মুরগি অটোমেটিক্যালি মরে যাবে বা বড় হবে না। আপনার খামারে খাবার দেওয়ার মাধ্যমে এই সর্বোচ্চ ক্যাপাসিটিটা কিছুটা হয়তো বাড়াতে পারেন, খুব একটা যে বাড়াতে পারবেন এমন না।
কিন্তু ন্যাচারাল এনভায়রনমেন্টে এটুকু বাড়ানোরও সুযোগও নেই। আর এই যে ইলিশের কথা বলছি, এরাও তো কিছু না কিছু খেয়ে বড় হয়, এদেরও ন্যাচারাল এনেমি থাকে, এদেরও রোগ হয়, এদেরও রিপ্রোডাকটিভ ডিফিকাল্টি থাকে-আপনি চাইলেই ইলিশে ইলিশে সয়লাব কখনোই করতে পারবেন না।
বিজ্ঞানের ভাষায় লজিস্টিক গ্রোথ কার্ভ নামে একটি বিষয় আছে। বায়োইকোনমিতে একে আশ্রয় করে বানানো হলো গর্ডেন-সেফার মডেল। এর ব্যাখ্যা করলে এমন হয় যে, যেকোনো প্রজাতি-যেমন ধরুন ইলিশ মাছ-এর সংখ্যা কোনো একটা নদীতে বা যেকোনো পরিবেশে ধীরে ধীরে বাড়বে। একটি সময় এ সংখ্যাটি আর বাড়বে না, জন্ম-মৃত্যু সমান হয়ে যাবে।
এখন কথা হলো, ইলিশের সংখ্যা না বাড়লেও আপনি কিন্তু ইলিশ সংগ্রহের পরিমাণ বাড়াতে পারেন। কিভাবে? আপনি জাস্ট ইলিশ ধরার কৌশল বাড়াতে থাকেন। আজকে নরমাল জাল দিয়ে ইলিশ ধরলেন, তো আগামীকাল কারেন্ট জাল দিয়ে ধরেন। এখন কথা হলো, এভাবে সংখ্যা বাড়লে আপনার ম্যানেজমেন্ট জোরদার হচ্ছে, নাকি আপনার ম্যানেজমেন্ট দুর্বল হচ্ছে? কথা থেকেই যাচ্ছে।
আপনাদের ইলিশ-জাতীয় রাজনীতি কিন্তু এই পৃথিবীতে প্রথম না। এর একটি ভয়ংকর উদাহরণ ইতিপূর্বে আমাদের কাছে আছে।
ব্রিটিশদের খাবার তালিকার অন্যতম একটি মাছ হলো কড মাছ। মূলত নর্থ সি থেকে এই কড মাছ সংগ্রহ করা হতো। সত্তর থেকে নব্বই এর দশকের সময় প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার হলো, এই কড মাছ সংগ্রহের পরিমাণও বেড়ে গেল। মাছের দামও বেড়ে গেল। কারণ, আপনি যত প্রযুক্তি, নতুন জাল বা এমন কিছু ব্যবহার করেন, জনবল যত বাড়ান-ততই মাছের দাম তো বাড়তেই হবে, নাহলে খরচ কিভাবে আসবে বলুন! সায়েন্টিস্টরাও ওয়ার্ন করল, বলল যে, এই যে হিসেবে মাছের পরিমাণ বছরকে বছর বাড়ছে তার রিজন কিন্তু মাছের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া না, বরং মাছ ধরার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। কিন্তু কে শুনে কার কথা! পলিটিশিয়ানরা এগুলোকে কমপ্লিটলি এভয়েড করলেন। ফলস্বরূপ, এই মাছ এবং এই ইন্ডাস্ট্রি কমপ্লিটলি কল্যাপ্স করল!
আপনারা তো অন্য মাছের তুলনায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইলিশের এক্সপোনেনশিয়াল দাম বৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছেন-আপনার কি মনে হচ্ছে না, আমরা সেই পথেই হাঁটছি? দুর্ভাগ্য-আমাদের দেশে এই পলিটিক্যাল এপ্রোচগুলোকে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য অনেক ডিপার্টমেন্ট যেন পথ চেয়ে বসে থাকে!


Post a Comment