এরপর আরেকবার, এক বৃদ্ধলোক আমি হাসার পরও আমার দিকে তাকিয়ে হাসেননি। সেটিও হয়তো কোনো রেসিজমের কারণেই!
জোকস অ্যাপার্ট! ইউরোপে রেসিজম হয়, একেবারে নেই-তা বলা যাবে না। তবে এসব যে রেসিজম, তা বুঝতে সত্যিই আমাদের অনেক মাথা খাটাতে হয়। আর, যেহেতু আমরা বিদেশে পাড়ি জমানো মানুষদের বেশিরভাগই কিছুটা-আধটু পড়াশোনা করেছি, পান থেকে চুন খসলেই মনে হয় অন্যায় হয়ে গেছে।
হ্যাঁ, অবশ্যই আমি বর্তমান সময়ের কথা বলছি। অতীতের অনেক ঘটনা আছে, সেসব আমার দেখার সুযোগ হয়নি। তবে, আমি বিশ্বাস করি অনাচার অনেক কমেছে।
শতকরা হিসাব করলে, বর্তমানে ইউরোপে ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশি-এটি যে কেউ স্বীকার করবে। অন্তত, আমাদের দেশ বা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে যেরকম রেসিজম হয়, তার তুলনায় এখানে হয় সামান্যই।
যেমন ধরুন, কোনো ইউরোপীয় যদি আমাকে রমজানের সময় জিজ্ঞেস করে,
"এতো দীর্ঘ সময় রোজা রাখো? কষ্ট হয় না?"
(আমাকে এই প্রশ্নটি কেউ করেনি, কেবল উদাহরণের স্বার্থে বললাম।)
এমন প্রশ্ন শুনলে হয়তো আমি হেসে বলব,
"না, কষ্ট হয় না, এটি কেবল অভ্যাসের ব্যাপার"
কিন্তু পরক্ষণেই মনে হতে পারে-আমার ধর্মের কোনো নিয়মকে কি কোনোভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করলো! এই ধরনের প্রশ্ন তখন আমার কাছে রেসিজমের মতো মনে হতে পারে।
এই সূক্ষ্ম সীমারেখা-এই যে কথার ধরনে আমার খারাপ লাগতে পারে, এটিও আমার চারপাশের অনেক ইউরোপীয় বিবেচনা করে চলে।
কিন্তু, আমাদের উপমহাদেশে তো হিন্দু-মুসলমান একে অপরকে খোঁচা দিতে পারলেই যেন জয়ী হলো!
ইউরোপীয়দের মধ্যে ফ্রান্সের লোকেদের রেসিজম নিয়ে মোটামুটি সুখ্যাতি (!) আছে। এ নিয়ে স্বয়ং ইউরোপীয়রাও কমবেশি অসন্তুষ্টি দেখায়।
যেমন, আমার জার্মান বন্ধু যখন শুনল যে আমার স্ত্রী- সুমা স্কটল্যান্ড থেকে ফ্রান্সে গিয়েছে, সে প্রথমেই বলে উঠল, "কেন! স্কটল্যান্ডের লোকেরাই তো ভালো!"
আসলেই তাই, স্কটিশরা ভীষণ ভদ্র। তবে, তাই বলে কি ফরাসিরা অভদ্র?
আসলে ব্যাপারটা ভিন্ন। ফ্রান্সের মানুষদের কথাবলার ধরন একটু আলাদা। তারা যদি দেখে আপনি ফরাসি বলতে চাইছেন কিন্তু পারছেন না, তাহলে হয়তো হেসে ফেলবে!
এটি তাদের কাছে মজার মনে হতে পারে, কিন্তু আপনার কাছে তা অপমানজনক লাগতেই পারে। এখানেই ঘটে বিপত্তি!
আজ ফ্রান্স থেকে জার্মানিতে ফিরছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত, ট্রামের শিডিউলে সামান্য গণ্ডগোল হয়ে যায়। ফলে, আমাকে চারবার ট্রাম বদলাতে হয়।
আমি একটি ছোট শহর থেকে ভ্রমণ করছিলাম। হয়তো সে শহরে গুগল ম্যাপে ট্রামের শিডিউলগুলো ভালোভাবে ইন্টিগ্রেট করা নাই, বা হয়তো এদের অন্য কোনো অ্যাপে সঠিক তথ্য থাকে যা আমার জানা নাই।
যাই হোক, পুরো যাত্রার মধ্যে চারজন মানুষ আমাকে সাহায্য করেছেন। এমন না যে আমি সবার কাছে সাহায্য চেয়েছি, বরং তারা নিজেরাই বুঝতে পেরে এগিয়ে এসেছেন।
তবে, আমি একজনের কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম। আমি জানতে চেয়েছিলাম, "এই ট্রামটি কি এয়ারপোর্টের দিকে যাবে?" তিনি আমাকে হ্যাঁসূচক উত্তর দিলেন। আমিও উঠে পড়লাম।
কিন্তু কিছুক্ষণ পর দেখি, সেই লোকটি হাঁপাতে হাঁপাতে আমার কাছে আসলেন এবং জানালেন যে তার ভুল হয়েছে! তিনি খবর নিয়ে জেনেছেন যে এই ট্রামটি আজ এয়ারপোর্টে যাবে না। এবং এই কথা বলতে বলতেই তিনি আমার সঙ্গে উল্টো দিকে এক স্টেশন ভ্রমণ করে ফেললেন!
ভাবুন ব্যাপারটা!
তিনি শুধুমাত্র সঠিক তথ্য দিতে এবং ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে আমার সঙ্গে যাত্রা শুরু করে দিয়েছিলেন।
ইউরোপীয়দের এই দায়িত্ববোধ আমাকে সত্যিই মুগ্ধ করে।
আপনি যদি কোনো ইউরোপীয়র সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলতে চান, তাহলে আপনার প্রথম ভাষা হওয়া উচিত- হাসি। আপনি যদি কারও সঙ্গে হেসে কথা বলেন, তাহলে সেও আপনাকে হাসিমুখে ও আগ্রহ নিয়ে উত্তর দেবে। এটি একটি দারুণ ব্যাপার!
আপনি যেমন বন্ধুত্ব দেশে পেতেন, যেমন পারিবারিক সম্পর্ক দেশে দেখতেন, তা আপনি এখানে দেখতে পাবেন না, এটা সত্য! তার মানে, এখানে বন্ধুত্ব নাই, পারিবারিক বন্ধন নাই ব্যাপারটা এমন না। যাস্ট ওদের আর আমাদের ওয়ে অব ল্যাঙ্গুয়েজ আলাদা!
যাহোক, ফ্রান্স থেকে জার্মানি ফেরার পথে সুমা আমার জন্য বিরিয়ানি দিয়ে দিল। সে বলেছিল, যেন বের হওয়ার সময় চামচও নিয়ে নিই। কিন্তু আমি তো এই বাড়তি ঝামেলা নিতে চাইনি! অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিরিয়ানি নেওয়া হলেও, চামচ নিতে ভুলে গেলাম।
এরপর জার্মানিতে নামার পর এয়ারপোর্টের রেভে সুপারশপে গেলাম ওয়ানটাইম কাটলারি কিনতে।
গিয়ে দেখি, ট্রাভেল কাটলারির দাম প্রায় দেড় ইউরো-একটি সুন্দর বাক্সে চামচ, কাটাচামচ, ছুরি সবই আছে।
ভাবলাম, আরেকটু খুঁজে দেখি, ওয়ানটাইম কিছু পাওয়া যায় কিনা।
এর মধ্যেই রেভের একজন কর্মী এসে আমাকে ওয়ানটাইম কাটলারি দেখিয়ে দিলেন। দাম লেখা ছিলোনা দেখে আমি বললাম, "কত পে করবো?" তিনি বললেন, "এটা ফ্রি!"
এর পরের ঘটনাটিও দারুণ।
আমি তাড়াহুড়ো করে ট্রেনে উঠে গেলাম। পানির বোতলে তখন পানি প্রায় শেষ। বিরিয়ানি খাওয়ার সময় মনে হলো, পানি থাকলে ভালো হতো!
এর মধ্যেই টিকেট চেকার এলেন। টিকেট চেক করার পর আমি জানতে চাইলাম, "আমি কি ট্রেনের কোথাও থেকে এই পানির বোতলটা রিফিল করতে পারব?"
তিনি ভীষণ দুঃখিত হয়ে জানালেন, "না, ট্রেনে এই সুবিধা নেই।"
আমি বললাম, "ঠিক আছে, কোনো সমস্যা নেই।"
এর মাত্র দশ মিনিট পর দেখি, সেই টিকেট চেকার আমাকে খুঁজে বের করলেন! তিনি বললেন, "সামনের স্টেশনে ট্রেন পাঁচ মিনিট দাঁড়াবে। তুমি চাইলে নেমে পানি নিয়ে আসতে পারো। তবে দেরি করোনা!"
এই হলো ইউরোপীয়দের মানসিকতা!
এখানে নানা ধর্ম, মত ও সংস্কৃতির মানুষ রয়েছে। কিন্তু নিষ্ঠা ও পরোপকারের ক্ষেত্রে তারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে যথেষ্ট দায়িত্বশীল।
অনেক ইউরোপীয়দের দ্বিচারিতা নিয়ে আমার ধারণা আছে। এমনকি, এটি নিয়ে আমি নানা জায়গায় আলোচনা করি।
তবে, অধিকাংশের গুণের কাছে এসব কিছু হার মেনে যেতে পারে নিশ্চয়ই!
-আবদুল্লাহ আল আশেক
বার্লিন থেকে গ্রাইফসভাল্ট ট্রেনে লেখা, জার্মানি, ৩ এপ্রিল ২০২৫।

Post a Comment